শুরুটা করছি একটি ঘটনা দিয়ে-
রমজান মাসের ঠিক চার মাস পূর্বে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন শামীম আহমদ ও হেলেনা বেগম। বিয়ের পর প্রথম রমজান মাসে ইফতারি আসবে সেই আশায় থাকেন বরের পিত্রালয়ের লোকজন। সিলেটের ঐতিহ্য হিসেবে যথারীতি হেলেনার বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে ইফতার পাঠানোও হয়। কিন্তু সেই ইফতার সামগ্রী শ্বশুরবাড়ির লোকজনের মনমতো হয়নি। আর সেটা নিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নানান কথা শুনতে হয় হেলেনাকে। এরই জেরে নিজ ঘরে ফ্যানের সঙ্গে রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন হেলেনা। ঘটনাটি সিলেটের জৈন্তাপুরের।
পুরো দেশেব্যাপী এরকম ৮/১০টি ঘটনা প্রতি রমাজনেই ঘটে থাকে। এরকম আত্মহত্যার ঘটনা এমনকি ডিভোর্স, অত্যাচার-নির্যাতনে কত বিবাহিতার সংসার তছনছ হয়ে যায় তার ইয়ত্তা নেই। ইফতারি, আম-কাঠালী, বরের আত্মীয়স্বজনদের কাপড়চোপড় উপহার সামগ্রী-সহ হরেক রকমের কুপ্রথা যেন আমাদের সভ্য সমাজের মানুষজন অসভ্যভাবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। এসব রেওয়াজ কতশত পরিবারের হাহাকার বয়ে আনে তা আমরা ক'জনই জানি? সামাজিক রীতির নামে সিজনালভাবে আমরা আত্মহত্যা, ডিভোর্স আর পারিবারিক কলহের জন্ম দিচ্ছি সেদিকে আমাদের কারো ভ্রুক্ষেপই নেই!
অথচ, রমজান মাস সিয়াম সাধনার মাস। নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, দান-সদকা ইত্যাদি ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার নৈকট্যলাভের সুযোগ মেলে এ মাসে। কিন্তু পবিত্র এই মাসে ইফতারি নামক নিন্দিত কাজ ক্ষুণ্ণ করছে রমজানের মাহাত্ম্য। ইফতারি প্রথা দরিদ্রদের জন্যে এক মহাআতঙ্কের নাম ও ধনবানদের জন্যে এক বিলাসী প্রথা।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই প্রথার প্রচলন রয়েছে। আর এটা এমনভাবে মহামারী আকারে ছড়িয়ে গেছে যে, শ্বশুরবাড়ি থেকে ইফতারি আসতেই হবে। অনেক সময় দরিদ্র বাবা মেয়ের সুখের জন্যে নিজের কষ্ট লুকিয়ে রেখে হাসিমুখে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি ইফতার পাঠায়। অন্যদিকে ইফতার প্রেরণেই যে মেয়ের নিষ্কৃতি মিলবে- এমন নয়। বাড়ির অন্য বউদের শ্বশুরবাড়ি থেকে পাঠানো ইফতারের সঙ্গে তুলনাও করা হয়। যার শ্বশুরবাড়ি থেকে যত বেশি ইফতার আসে তার ততো সুনাম। তেমনি যে মেয়ের বাবার সে সক্ষমতা কম তিনি ইফতার দিয়ে খুশি করতে না পারলে অনেক ক্ষেত্রে কথা শুনতে হয় মেয়েকে।
হয়তো মেয়েটি জানে তার বাবার অবস্থা তবুও শ্বশুরবাড়িতে নিজের সম্মানজনক অবস্থান ধরে রাখতে অনেক সময় ভেতরে চাপা কষ্ট নিয়েই বাবাকে অনুরোধ করে। মেয়ের আবদার ফেলতে পারেন না বাবা। যেভাবেই হোক টাকা সংগ্রহ করেন। সামাজিকতার এই নিয়মের চাহিদা মেটাতে কেউ সুদে টাকা নেন, কেউ গরু বিক্রি করেন কেউবা নিজের চিকিৎসার টাকা দিয়ে ইফতার সামগ্রী কিনে মেয়ের বাড়িতে পাঠান।
পক্ষান্তরে বিত্তশালী পরিবারগুলোতে চলে ইফতার প্রেরণের প্রতিযোগিতা। কে কতো বেশি ইফতার পাঠালো, কতো খরচ করলো- এ জাতীয় হিসাব-নিকাশে চলে যায় রমজান মাস।
তবে এই প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার বর্তমান প্রজন্ম। অনেকেই এ কুপ্রথা ভেঙ্গে দিতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। আমি নিজেও এই প্রথার ঘোর বিরোধী। আমার বিয়ের পর এবারের রমজানই প্রথম রমজান মাস। সে উপলক্ষে আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে ইফতারি আসবে এমন প্রস্তাবনা শুনার সাথে সাথেই আমি তা শক্তভাবে বারণ করি। সবাইকে বুঝিয়ে বলি এসব কুপ্রথা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিৎ। কিন্তু শশুড়বাড়ির লোকজন সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যাহার করতে মোটেও রাজি নন। কিন্তু আমার অনড় অবস্থান এবং বিস্তর আলোচনার পর উনারাও নিজেদের সিদ্ধান্ত বদল করেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে একটি বিষয় বেশ পরিষ্কার, আর তা হচ্ছে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব কুপ্রথা আমাদের সমাজে বেশ শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়েছে। আমার শ্বশুরালয়ের সকলেই সমাজ সচেতন মানুষ। অথচ এই কুপ্রথাকে উনারাও সহজে বর্জন করার পক্ষে নয়। তার একমাত্র কারণ আমাদের সমাজের দৃষ্টিকোণ। আমার ঘরে ইফতারি না আসলে হয়তো উনাদের মেয়ের সম্মান কমে যাবে, অথবা আশেপাশের অনেকের ইফতারি আসবে আমার ঘরে না আসলে তা বেমানান দেখাবে এমন চিন্তা প্রত্যেক শ্বশুরালয়ের মানুষজনের মনে বিচরণ করে। বাস্তবে ঘটেও তা। সুতরাং ইফতারি প্রথা বর্জন করতে হলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
আমি এব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। কে কি মনে করলো তাতে আমার ভ্রুক্ষেপ নেই। ইফতারি না আসলে যে গৃহকর্ত্রীর সম্মান কমে যাবে কিংবা তা মানদণ্ডে বিচার করা হবে তার পক্ষে আমি মোটেও নই। প্রসঙ্গত বলতে হয় যে, শ্বশুরালয় থেকে চাইলেই ৫০০ মানুষের ইফতারি আসবে এমন সামর্থ্যও উনাদের রয়েছে, মাশাআল্লাহ। কিন্তু চাইলেই ইফতারি পাওয়া যাবে তবে সমাজ থেকে ব্যাধি দূর করা চাইলেই সম্ভব নয়। তাই আমরা যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে এসব ব্যাপারে এখনই সোচ্চার না হই তবে তা দূর করতে আরোও এক মহাকাল পথ পাড়ি দিতে হবে।
সমাজে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এসব কুপ্রথা সামাজিক ব্যাধি হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করে ফেলেছে। তাই আসুন সবাই এসব কুদৃষ্টিভঙ্গি ও ইফতারি, আমকাঠালী-সহ সকল কুপ্রথার ব্যাপারে সোচ্চার হই। মনে রাখবেন, এসব কুপ্রথাকে যারা উৎসাহিত করেন তারা সকলেই আত্মহননকারী, বিবাহ বিচ্ছেদ ও নির্যাতনের শিকার গৃহবধূর জন্য সমান অপরাধী। তাই এসব কুপ্রথাকে উৎসাহিকরণ নয়, দৃঢ়তার সহিত বর্জন করুন। কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়-
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!'
বর্তমান প্রজন্মের সকলেই সচেতন, তাই এ প্রজন্ম জেগে উঠলেই রাত পোহাবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
সালমান কাদের দিপু
সম্পাদক ও প্রকাশক
কুশিয়ারা নিউজ।