Saturday 3 April 2021

মোদী বিরোধী আন্দোলন ও বাংলাদেশের বাস্তবতা



মোঃ আব্দুল মালিকঃ

বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমন ঠেকাতে বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থী কিছু দল ও তাদের সমমনা ব্যক্তি, দল ও প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচী গ্রহণ করে।তাদের অভিযোগ নরেন্দ্র মোদী বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির নির্মাণ করেছেন, গুজরাটে মুসলিম হত্যার সাথে জড়িত, ফারাক্ষা ও তিস্তা সমস্যার সমাধান না করা, বাংলাদেশে গরু ও পিয়াঁজ রপ্তানী বন্ধ করা ইত্যাদি ইত্যাদি। এর অনেক অভিযোগ অবশ্য সত্য।

এখন প্রশ্ন হলো মোদীকে আমন্ত্রণ জানানো হলো কেন ? এসব
অভিযোগের প্রেক্ষিতে সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে মোদীকে আমন্ত্রণ না
করলে মোদীর কী কোন ক্ষতি হতো ? আর বাংলাদেশের এবং মুসলমানদের কী লাভ
হতো ?

প্রথমেই মোদীকে আমন্ত্রণ জানানোর কারণ-
১) বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানের সাথে ভারত ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে যখন আমাদের মুসলিম পশ্চিমা ভাইয়েরা রাতের অন্ধকারে, ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদেরকে কাফির ফতোয়া দিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা শুরু করে, আমাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, খাদ্য গোদাম ইত্যাদিতে অগ্নি সংযোগ করে, মা বোনকে নির্যাতন করে তখন কেউই আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে নাই। সেদিন সকল মুসলিম দেশও
ছিল নিরব। তখন এগিয়ে এসেছিল একমাত্র প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত। ভারত তার সীমান্ত খুলে দিয়ে এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দেয়, নয় মাস ব্যাপী থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, সর্বোপরি ভারতীয় বাহিনী আত্মাহুতি দিয়ে আমাদের স্বাধীনতাকে তরান্বিত করে। তাই ভারতকে নিমন্ত্রণ করা বাংলাদেশের নৈতিক দায়িত্ব।

২) ভারতের সাথে আঞ্চলিক ও আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক সম্পর্ক রয়েছে। ভারত সার্ক, জোট নিরপেক্ষ, কমনওয়েলথ ও জাতিসংঘের প্রভাবশালী সদস্য। সেসব সংস্থায় বাংলাদেশও সদস্য। পররাষ্ট্র বিষয়ে বাংলাদেশের সাফল্যের জন্য ভারতের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখা অবশ্যই প্রয়োজন।

৩) ভারত হচ্ছে বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশি বৃহৎ একটি রাষ্ট্র। বাংলাদেশের তিনদিকে ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। বহুক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো ভারতের উপর নির্ভরশীল। প্রতিবেশির সাথে সু-সম্পর্ক বজায় না রাখলে বহুবিদ সমস্যা হয়। আর সেই প্রতিবেশি যদি হয় প্রভাবশালী, তাহলে তো কথা নেই। উপরন্তু প্রতিবেশির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ইসলামেরও নীতি। ভারতকে নিমন্ত্রণ না করে অন্যান্য প্রতিবেশি রাষ্ট্রকে, ভারতের মিত্র রাষ্ট্রকে নিমন্ত্রণ করা যেত না, নিমন্ত্রণ করলেও আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যেত না, আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক, পররাষ্ট্রনীতি অন্য বিষয়। পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার আগেই ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু ভারতের বিরোধিতা সত্ত্বেও পাকিস্তানে ও আইসির সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে পাকিস্তানকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান না আসতে পেরে বাণী পাঠিয়েছেন, এটাই বাস্তবতা। বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদীকে নিমন্ত্রণ করা হয় নি। করা হয়েছে ভারতের সরকার প্রধানকে। সেই রাষ্ট্রের নির্বাচিত সরকার প্রধান হিসেবে মোদী এসেছেন। তিনি কোন কারণে আসতে না পারলে
তাঁর প্রতিনিধি পাঠালেও বাংলাদেশ গ্রহণ করতো, যেমনটি অন্য দেশের ক্ষেত্রে হয়েছে। এই গেলো সংক্ষেপে নরেন্দ্র মোদীকে নিমন্ত্রণের কারণ।বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভারতকে, নরেন্দ্র মোদীকে নিমন্ত্রণ না করলে তাঁদের কি কোন ক্ষতি হতো ? এক কথায় না। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ভারতকে নিমন্ত্রণ না করলে তার মোটেই ক্ষতি হতো না। বর্হিবিশ্বের কোন দেশ ভারতকে জিজ্ঞাসা করতো না, ‘তোমাদেরকে বাংলাদেশ নিমন্ত্রণ করে নাই কেন ?’ বরং বাংলাদেশকে অনেক রাষ্ট্র বলতো, তোমরা ভারতকে নিমন্ত্রণ করো, না হলে আমাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। ভারতকে নিমন্ত্রণ না করলে বাংলাদেশের কী কোন লাভ হতো ? না। মোটেই লাভ হতো না বরং বর্তমানে যতটুকু সু-সম্পর্ক রয়েছে তার আরো অবনতি ঘটত। ভারত ও কাশ্মীরের মুসলমান, বাংলাদেশের জনগণ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতো। তার প্রমাণ বাবরী মসজিদ, গুজরাট হত্যাকান্ড ইত্যাদি।

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভারতীয় বা বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মুসলমানদের সম্পদ নয়, এটা বিশ্ব মুসলিমের একটি সম্পদ। বিশ্বের মুসলিম বা ওআইসি এ বিষয়ে কী করেছে ? কিছু কি করতে পেরেছে ? পারে নাই। যদি নিমক হারামের মতো বাংলাদেশ ভারতকে নিমন্ত্রণ না করতো, আর ভারত সে দেশের ২৫ কোটি মুসলমানের উপর, বাংলাদেশের সীমান্তে অত্যাচার নির্যাতন বাড়িয়ে দিতো, অর্থনৈতিক, পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে নেতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করতো তা কী বাংলাদেশের জন্য, মুসলমানদের জন্য সুফল বয়ে আনতো।এক কথায় না। বরং যতটুকু সম্পর্ক রয়েছে, যতটুকু সুবিধা পাচ্ছে তাও পেতো না। যে দেশে করোনার টিকা উৎপাদিত হয়েছে সেদেশের সাধারণ মানুষ টিকা পাওয়ার আগে ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আগে টিকা পেয়েছে। হেফাজতের বর্ষিয়ান নেতা সদ্য প্রয়াত আল্লামা আহমদ শফি ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পেরেছেন। আরো বহুক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় অনেক বিষয়ে বাংলাদেশ ভারত থেকে সুবিধা পাচ্ছে। হ্যাঁ তিস্তা সহ অনেক ইস্যুতে সমস্যা আছে। তার সমাধান করতে হবে সু-সম্পর্কের মাধ্যমে, কূটনৈতিকভাবে। উগ্রতা দিয়ে ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ হয় না। সাদ্দাম হোসেন, মোল্লা ওমর, উসামা বিন লাদেন উগ্রতা দিয়ে ধ্বংশ হয়েছেন, দেশ ও জাতিকে ধ্বংশ করেছেন। এটা ইসলামও সমর্থন করে না। আল্লাহর নবী মক্কাশরীফের ভিতর মূর্তি রেখে নামায আদায় করেছেন, হজ¦ আদায় করেছেন। যখন তাঁর পরিপূর্ণ শক্তি অর্জিত হয়েছে কেবল তখনই তিনি মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেছেন। তাই পবিত্র কুরআনে ধৈর্য্য ধারনের কথা একাধিক বার বলা হয়েছে।

আমাদের দেশের আলেম সমাজ ও একশ্রেণির রাজনীতিবিদ কী এসব জানেন না বা বুঝেন না ? উনারা ঠিকই জানেন এবং বুঝেন। এটা ভারত বা মোদী বিরোধিতা নয়, এটা আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ
বিরোধিতা। কয়েক মাস আগে উনারা ভাস্কর্য বিরোধিতা করে মাঠ গরম করতে না পেরে এখন মোদী বিরোধিতায় নেমেছেন। এই ভারত বিরোধিতা শুরু হয়েছে ১৫ আগস্ট ৭৫ এর পর থেকে। দেখা যাক কোন সরকারের সময় ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন ছিল, কোন সরকার ভারত থেকে কতটা সুবিধা আদায় করেছিলেন- বঙ্গবন্ধুর সরকার অতি অল্প সময়ের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন, বিশ্বের ইতিহাসে যার নাজির নেই। বঙ্গবন্ধুর সরকার ফারাক্ষার পানিচুক্তি করেছিলেন ৪৪ হাজার কিউসেকের বিনিময়ে। বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাত করে এক পর্যায়ে জেনারেল জিয়ার সরকার ক্ষমতায় আসেন। এই সেই
জেনারেল জিয়া যিনি একাত্তর সালে যুদ্ধরত কমান্ডারদের মধ্যে প্রথম ভারতে যান এবং স্বাধীনতার পর সকলের শেষে দেশে ফিরে আসেন। তিনি ফারাক্কা চুক্তি করেছিলেন ৩৪ হাজার কিউসেকে। এক পর্যায়ে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসেন। এই জেনারেল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২ বার বাংলাদেশে এসেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন নাই। ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি ছিলেন ভারতে উচ্চতর প্রশিক্ষণে। ১৫ আগস্টের ঘঠনা শুনেই তিনি প্রশিক্ষণ ফেলে বাংলাদেশে চলে আসেন এবং জেনারেল জিয়া এক পর্যায়ে তাকে সেনা প্রধান নিয়োগ করেন। সেই এরশাদ ভারতের সাথে ফারাক্ষার পানি চুক্তি করেন ২৪ হাজার কিউসেকে। পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসেন বেগম জিয়া। তিনি ভারতের সাথে কোন পানি চুক্তি করতে পারেন নাই। ভারত সফর শেষে দেশে আসার পর এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘পানি বিষয়ে আলোচনা করতে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন।’

জাগপা নেতা শফিউল আলম প্রধানের হুমকির প্রেক্ষিতে বেগম খালেদা জিয়া একাধিক বার সার্ক শীর্ষ সম্মেলন পিছাইয়া ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওকে শেষ পর্যন্ত শফিউল আলম প্রধানকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশে এনে
সম্মেলন করেছিলেন। সীমান্ত হত্যা সহ অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশের কোন্ধসঢ়; সরকার বা কোন জেনারেল ভারতের নিকট থেকে কতটা সুবিধা আদায় করেছিলেন, ভারতকে কতটা সুবিধা দিয়েছিলেন এর তুলনামূলক আলোচনা করলে বেরিয়ে আসবে প্রকৃত সত্য, বাংলাদেশে কারা ভারতের তাবেদার বা দালাল।


মোঃ আব্দুল মালিক
শিক্ষক, কলামিস্ট

সহ-সভাপতি
বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, সিলেট জেলা, শাখা।
সাধারণ সম্পাদক
বঙ্গবন্ধু গবেষণা সংসদ, সিলেট জেলা, শাখা।
০২-০৪-২০২১খ্রিঃ।

শেয়ার করুন