Sunday 22 May 2022

বই আলোচনা: ইমেইল বডিতে সময়ের অনুবাদ


গ্রন্থ আলোচনা 
-সাঈফ ফাতেউর রহমান

গ্রন্থের নাম:  ইমেইল বডিতে সময়ের অনুবাদ
গ্রন্থের প্রকৃতি: কাব্যগ্রন্থ 
গ্রন্থকার; এ কে এম আব্দুল্লাহ
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৯
স্বত্ব: লেখক
প্রকাশক: অনার্য পাবলিকেশন্স লি:
১১১ নয়াপল্টন (৬ষ্ঠ তলা) পল্টন-১০০০
প্রচ্ছদঃ  অনিন্দ্য রাইয়ান 
মুদ্রণঃ প্রিয়াংকা প্রিন্টার্স
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৭২
কবিতা সংখ্যাঃ ৬৪
মূল্যঃ ১৮০  টাকা

কবি এ কে এম আব্দুল্লাহ প্রবাসী কবি। যুক্তরাজ্যে দীর্ঘ প্রবাসেও বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে তার সংযোগ ও সংহতি অচ্ছেদ্য। নিবিড় অধ্যাবসায় ও অনুধ্যানে তিনি বাংলা সাহিত্যের নিবেদিত সেবায় নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন। বিদেশের ব্যস্ততমতার মাঝেও নিজ সাহিত্য ও সংস্কৃতি লালন কেবল নয়, এর পৃষ্ঠপোষকতা, প্রসার ও সামগ্রিক উন্নয়নে একাগ্রতায় নিজেকে নিবিষ্ট রেখেছেন। বিশেষত কবিতা প্রেম তাঁর অন্তর্প্রবাহে যে সুমিত বোধ প্রতিনিয়ত উন্মোচিত ও পরিবর্ধিত হয় তা এক অনাবিল সুরময়তার আসমুদ্র সুন্দরতা বিস্তৃত করে দেয়। জীবনের আবৃত অনাবৃত সমুদয় দিক এবং অনাস্বাদিত জীবন বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা এবং আগত দিনের জীবন অনুভবের অগ্রিম দ্যোতনা সন্নত প্রভাবনা তাঁর অস্তিত্বের মর্মমূলে সুবহ প্রাণসঞ্জীবণী সুবিস্তার করে। অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত অসামান্য গুঞ্জরণে বিপুল সংবেদী জীবনময়তা তাঁকে আবিষ্ট করে। তিনি নিবিড় সুন্দরের অতল থেকে অতলতরতায় অবগাহন করতে থাকেন। নিমীলিত চোখ অথচ উন্মিলিত মনন সুরভিময়তায় তিনি প্রত্যক্ষ করেন চলমানতা এবং আগত  দিনের সকল শুদ্ধ চৈতন্যের উন্মেষের মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রতিকূলতার অচলায়তন অপসৃত হয়ে যেতে থাকে, জীবন অপার্থিব জোৎস্নাময় প্রভায় নন্দন সুস্নিগ্ধ হয়ে ওঠে আর হৃদ-অতলান্তিকের গভীরময়তার ভেতর থেকে সৃষ্টি সমগ্র ঝংকৃত করে বেজে উঠতে থাকে অমল জীবনের শুদ্ধস্বর। উচ্চকিত ভাবনাকে অবলম্ব মেনে কবি উদ্বেল আনন্দ অবগাহনে নিজেকে আবিষ্কার এবং প্রতি আবিষ্কার করতে থাকেন। প্রতিনিয়ত এই বোধিক শ্রীময়তার মাঙ্গলিকে তিনি ক্রমোত্তীর্ণ হতে থাকেন জীবনের সঘন মায়াবী পুলকানন্দে। 

কবি এ কে এম আব্দুল্লাহ কবিতা ও জীবনকে এক সুতোয় গ্রথিত করে ফেলেন। বুনন শোভনতায় জীবন হয়ে ওঠে আদিগন্ত এক নকশী কাঁথা। এর স্থানিক বিন্যাসে সব সুর, সব স্বপ্ন, সব শ্রী, সব অশ্রী, সব সুশীল ও দুঃশীল স্থাপিত হয় ভারসাম্যময় সহাবস্থানে। নকশী কাঁথার চিত্রিত বৈচিত্র্যে প্রতিফলিত রোদ্দুরের মায়াবী জাদু। আর অন্তরীক্ষে পাশব সত্তা নিয়ে কূটিল উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে ধুরন্ধর ইঁদুর কোন। কখনো ড্রাকুলা অস্তিত্বমান হতে থাকে। তবে বাস্তবের পাহাড় প্রতিবন্ধক অতিক্রমণের দুঃসাহসিকতা অর্জনে অক্ষম, নিজের বিবরাশ্রয়েই ফিরে যায়। কবি আব্দুল্লাহ’র কবিতার মন্ময় হেসে ওঠে। সোনারং রোদ্দুর ঝিলিমিলি করে। ইমেইল বডিতে সময়ের অনুবাদ, প্রতিরোধ দেয়াল অতিক্রমণের অসাধ্য সাধন করে। কবি আব্দুল্লাহ’র সৃজন পেলব হাসির ঐন্দ্রজালিকতায় আলোক ছড়ায়।

কবি এ কে এম আব্দুল্লাহ’এর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ “ই মেইল বডিতে সময়ের অনুবাদ”।প্রথম কাব্যগ্রন্থ “সচেতনা” দিয়ে তার যাত্রারম্ভ। পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করেছেন কাব্যগ্রন্থ” মাটির মাচায় দন্ডিত প্রজাপতি” ও “ যে শহরে হারিয়ে ফেলেছি করোটি”। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে তাঁর উপন্যাস “ক্ষুধা ও সৌন্দর্য”। সম্পাদনা করেছেন অণুগল্প সংকলন “শব্দবিন্দু”। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান থেকে পুরষ্কৃত হয়েছেন সাহিত্যকর্মের জন্য। ব্যস্ত জীবনের মাঝেও সাহিত্য সাধনা বিশেষত কবিতার সাথে তাঁর হার্দ্যিকতা নিবিড় ভালোবাসার সুরানুভবে উদ্বেল। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের কেনিংটাউনে বসবাস করলেও তাঁর অন্তর গভীরে এখনো দীপ্যমান বনগ্রাম, গোলাপগঞ্জ, সিলেট, বাংলাদেশ।

কাব্যগ্রন্থ “ই মেইল বডিতে সময়ের অনুবাদ” মৌলিক ভাবনার সুচিত্রায়নে আধুনিক এবং ক্রম বিস্তৃতিতে উত্তরাধুনিক কবিতার অঙ্গনে প্রবেশ শুধুই নয়, শক্ত ভিতের উপরে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার দুর্মর শক্তিমত্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে।  চিত্রকল্প, আধুনিকতা এবং আধুনিকতার যাবতীয় অনুষঙ্গ, প্রযুক্তি এবং তার জীবনানুগ সংশ্লেষ যেমন বাঙ্ময়, তেমনই দৈশিক চেতনা, দেশপ্রেম, মানবপ্রীতি এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের মশাল তুলে ধরার প্রত্যয়ী সুহাস কবিতার অণুতে পরমাণুতে। বীক্ষণ এবং বিশ্লেষণ সহজায়ত্ব না-ও হতে পারে সকলের জন্য, তবে নিষ্ঠ কবিতাপ্রেমী পাঠক এই কাব্যগ্রন্থ পাঠে আদ্যন্ত অনুন্মোচিত রহস্যাবরণ উন্মোচনের স্বাদ এবং আহ্লাদ যুগপৎ মেটাতে পারবেন।

কবি এ কে এম আব্দুল্লাহ তাঁর কাব্যগ্রন্থ “ই মেইল বডিতে সময়ের অনুবাদ” উৎসর্গ করেছেন-
“পাঠক
দু’হাজার বাহান্ন সাল” কে।
উৎসর্গপত্রেই কবির স্পষ্ট ইঙ্গিত আগত দিনের কবিতা এবং কবিতাপ্রেমীদের সাথে সংযোগ ও সংশ্লেষ এবং মিথস্ক্রিয়ার প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য ইচ্ছা বা আকাঙ্খা তাঁর অন্তর্জগতে আপাত অন্তরীন থাকা মোটেই অসম্ভব নয়। 
কাব্যগ্রন্থটির একটি বড় অংশ নিরেট গদ্যরীতিতে নির্মিত কবিতা। অথচ পাঠক অনায়াসে অনুভব করবেন এর অন্তঃস্থ কবিতা-গীতির কলস্বর। কয়েকটি কবিতার আংশিক উল্লেখ করা যেতে পারে।

কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা “পেনড্রাইভ ও একটি কবিতা”।
“স্মার্ট টিভি থেকে নেমে আসা ইমোশনে আমি আনন্দায়িত হই। আর এই দৃশ্য দ্যাখে ধূমায়িত ল্যাটের কাপে-নিজস্ব আইটিউব থেকে নেমে আসে একবিংশ শতাব্দীর সুরেলা চিত্র এবং পকেটের ভেতর থেকে স্যামসং ফোন কাঁপিয়ে বেরিয়ে আসা নিপুণ হাত আমার প্লেটে ঢেলে দিলে দইবড়া; কাঁটাচামচের ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ে পংক্তির মাপজোখ। আমার ভেতরে পরাবাস্তবতা প্রখর হয়ে ওঠে। আমি স্কেইট বোর্ডের ওপর ক্যামেরা রেখে যে কবিতা নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম, তার ভেতর অকস্মাৎ ভর করে আন্ড্রে ব্রেটন।----------------------------- 
---------- এরপর দৃশ্যগুলো পেনড্রাইভে সেভ করে ঢুকে পড়ি নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে। যেখানে দৃশ্যায়িত হচ্ছে আগামী শতাব্দীর একেকটি কবিতা।“ 
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের এই জীবন বাস্তবতায় হিরন্ময় উপলব্ধির নিবিড়তায় নির্মিতি এই কবিতা সংবেদী পাঠককে আপ্লুত করবে সন্দেহাতীতভাবেই। 

“আঁধারে রঙিন ফ্লেক্সিলোড” এক অসামান্য দ্যোতনাময় রূপকাশ্রয়ী গীতল কবিতা- 
“ফাইভস্টার হলরুমে আমাদেরকে নিয়ে যে এক্সিবিশন হয়-সেখানে কাঁচের মুগ্ধময় গ্যালারিতে আমরা শোভা বৃদ্ধি করি।এরপর পার্সেন্টেজের গড় দরকষাকষি শেষ হলে পৃথিবীর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো আমাদের মুখচাউনি স্পন্সর করে। আমরা পণ্য হই। আমাদের মাথা স্পর্শ করে সেই স্পন্সরের আশীর্বাদ। স্যুট-বুট পরে কেউ নিয়ে যায় তাদের বাড়িতে।“

কবি’র মনোজগতে এবং অন্তর্জগতে কখনো বোধিক শূন্যতার হাহাকারের প্লাবন নামে। ধূসর পান্ডূরতায় সমাকীর্ণ হয় চারপাশ। এরই অনিন্দ্যসুন্দর রূপায়ন “মেটেলের পাখি ও সাহারা প্রকল্প” কবিতায়- 
“মাঝে মাঝে আমার স্বপ্নের ভেতর, পুরো পৃথিবী একটি সাহারা মনে হয়। যে সাহারা, বুকে পাখি পুষে। পাখিটি কৌশলে শুধু নিজের কথা বলে। সারাটি বছর কেবল অজুহাত খুঁজে। একসময় সাহারার দেহ শুকিয়ে গেলে পাখিটি উড়ে যায় নিজের দ্বীপে।---------------------------------------
-----------আমি ভেঙে যাওয়া জকিদের পাশে দাঁড়িয়ে দেখি কর্তালের ঝংকার  থেকে নেমে আসা সুটুযে- এমজে ফন্টজে-বিগত রচনা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে অন্যপথে।--------আর সাহারা তখন সদ্যমৃত উটের জিহ্বা চুষছে বাহুতে জড়িয়ে।“

“সময়ে কপি পেস্ট” প্রতীকি ব্যাঞ্জণাময়তায় উত্তর আধুনিক কবিতার অনবদ্য সুপ্রকাশ- 
“দুর্বাঘাসের ঠোঁট বেয়ে নেমে যাচ্ছে দেহের লাল রং--------------
--------মাঝেমধ্যে আমাদের হাত-পা-মাথা কেটে কেটে ছুড়ে দিই সজ্জিত ট্যাংকের ওপর। আমরা ধর্ম-কর্ম নিয়ে বড়াই করি। ধর্মগ্রন্থ গলায় ঝুলিয়ে রাখি।------------------------------
--------এভাবে আমরা ভুলে গিয়ে সিনাই পর্বতের কথা; উটপোড়া মাংসের গুহায় যাই ডুবে। পিরিচ ভর্তি আত-ত্বীন আর জাইতুনের স্বাদ নিতে নিতে আমাদের গাউনের ভেতর জমে আঁধারদানা।“

“একটি প্রার্থনার অনুবাদ” কবিতায় অনুভব ও আত্মজাত সমীক্ষণে জীবনের গভীরতর বেদনা, প্রতিবন্ধকতা এবং অনিবার্য দ্বৈরথের পারঙ্গম উপস্থাপন। 
“ইলিশের পেট থেকে যখন নেমে আসে সাংস্কৃতিক পেটি আমরা উডেন ওভেনে গ্রিল করি। আর ড্রয়িংরুমে বসে বসে সুইটি-চিলি সস লাগিয়ে খাই। এসব দৃশ্য তুলে রাখি ইউসবির তাকে।-----------
-------------------আমাদের ঝুড়ি ভরে যায় পদকে। আমাদের মেধা পাচার হয়ে যায়। আমরা সাধারণ মানুষের ভাবনা কেনাবেচা করি।------------------------------------------------------
------আমাদের ভেতর জ্বলে ওঠে ইলেকট্রিক হিটারের আগুন। এ সুযোগে ওরা আমাদের দেহে হাত সেঁকে, আর ওমের নেশায় কামনা করে আমাদের দীর্ঘ জীবন।“

“আয়না দর্শন ও ব্ল্যাক প্রতিবিম্ব” কবিতাটি সমকালীন বিপর্যয়ী বৈশ্বিক বিপর্যয়করতার বিভ্রমিত, ধ্বস্ত চিত্রায়ন। 
“আজকাল আমাদের বিশ্ববাজারে মৃত্যুর হাট বসে। বেচাকেনা হয় নানা ধরণের মৃত্যু।মাঝে মধ্যে যখন ডিসকাউন্ট রেট নেমে আসে বাজারে-জমে ওঠে আড়ত----------------------------।“

“তোমার কানের রিং-এ ঝুলে থাকে রোমান্টিক বিকেল” চিত্রময়তায় দুল্যমান সোনালি অনুভবের জারিত সুন্দরতা- 
“তোমার কানের রিং-এ যখন ঝুলে থাকে এই রোম্যান্টিক বিকেল, রাতেরা জেগে ওঠে। আর নিশিগন্ধা মেলে ধরে তার বসন ।--------------------------------------------------
---------এখন তোমার চোখের ঝিলে ফোটা পদ্মের সাথে চাঁদ নয়; আমাদের মিতালি ফটোকপি হয় অন্তর্জালে। আর আমি তোমার সিঁথির ফ্রন্টগার্ডেনে বসে বসে কামনা করি পৃথিবীর দীর্ঘায়তা।“

জটিল গ্রন্থিময় যাপিত জীবনানুষঙ্গের অমিত শক্তিময় নির্মিতি“দূরবর্তী অ্যাপেল শহর ও একটি দুর্বোধ্য আসন” কবিতাটি- 
“মানববন্ধন শেষে আমাদের প্রতিবাদগুলো বাজেয়াপ্ত হয়ে গেলে সারারাত সেলফায়িত সুখ আমাদের পেঁচিয়ে রাখে। আর বিশ্বের ফ্লাওয়ার এক্সিবিশন থেকে কিছু খুশবু ফটোকপি করে এনে আমরা ছিটিয়ে দেই সম্পাদকীয় বিছানায়-------------------------------------------।“

বাণিজ্য আধিকারিকের আধিপত্য এবং বিশ্ব বাজার অর্থনীতির ভারসাম্যহীন প্রপীড়ন’এর অসাধারণ চিত্রকল্পময় উপস্থাপন  “জন্ম এবং মোহের বিকল্প মমতা”
“গলা কেটে আমাদের হত্যা করা হলে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো বিজি হয়ে ওঠে। হকারের কণ্ঠ বেয়ে বেয়ে নামে হেডলাইনগুলো।-------------------------------------
-----আমাদের কনফিডেনশিয়াল ফাইল বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। ------------
আমাদের মুন্ডুহীন দেহ বেয়ে বেয়ে নামে জন্মঋণ-------------------------------।“

“একটুকরো ওপেন সিক্রেট সময়ের প্রিন্ট কপি” সমকালীন অঋদ্ধ যুগযন্ত্রণার বাস্তবতায় বৈরি সরিসৃপের আগ্রাসী লোভাতুরতার প্রেক্ষাপটে নির্মিত নৈর্বক্তিক কবিতা। 
“এরপর মায়ের হাতে চুড়ির শব্দ মরে যায়। আমাদের পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসে। আর, মা মৃত রাস্তার ভিতর দিয়ে হাঁটতে থাকেন।-----------------------------
---------নবজাতকের মতো আমাদের দেহ কাঁপতে থাকে। আর আমরা ভুলে যাই মায়ের মুখচ্ছবি। আমরা ভুলে যাই আমাদের দেহে ডানা গজানোর গল্প।“

“সার্পনার ও একটি পরত্যক্ত জ্যামিতি বক্স” আর একটি চিত্রকল্পময় গভীর সংবেদী কবিতা। 
“------------------------------------------সার্পনার আর জ্যামিতি বক্স নাড়াচাড়া করতে করতে যখন শেষদিগন্তে সূর্যোদয় হয়; তখন মনে হয় আসলেই, পৃথিবী বেঁচে রয় আমাদের বিশ্বাসের ভেতর।“

অর্থনীতির আগ্রাসী অমানবিকতা আর শোষন বঞ্চনা প্রপীড়িত পৃথিবীতে  ধন-ভিত্তিক অর্থনীতি এবং এর অনিবার্য অনুষঙ্গে বিভাজিত সমাজের ধনবৈষম্যের প্রেক্ষিতে এক অসামান্য উপস্থাপন “ওয়ালেট” কবিতাটি। 
“ওয়ালেটের ভেতর থেকে যখন নেমে এলো স্বপ্নগুলো; তখনো আমার জানা ছিল না জীবনের মানে।------এখন আমার কাছে দুধরাজ সাপের স্কিন দিয়ে তৈরি একটি চেঁড়া ওয়ালেট আছে। ভেতরে জমা আছে কিছু গলাধাক্কা আর পায়ে পিষ্ট মৃত্যু।”

“অ্যাপস এবং আমরা” প্রযুক্তি ও মানবিক অনুভবের সংশ্লেষ ও বিশ্লেষের ছান্দসিক নির্মিতি। 
“আমরা এন্ড্রয়েড ফোন থেকে কিছু আনন্দ ডাউনলোড করে ইমেইল করি দেহের ভেতর। আর আমরা সামাজিক হয়ে উঠি। আমাদের বুকের জমিন গেড়ে ভিনদেশি পতাকার খুঁটি আন্তর্জাতিক হই।---------------------------------------------------------------------------------
------আমরা জংলি হয়ে উঠি। আমরা মানুষ হত্যা করে পবিত্র হই। রক্ত পান করি ক্রানবেরি জুসের মতো।  ধীরে ধীরে আমাদের রং ফ্যাকাশে হতে থাকে। আমরা একসময় এক্সপায়ারড হয়ে যাই-----------------------।“

“ব্রাকেটবন্দী পুতুলের বিলাপ” নৈবর্ক্তিক চেতনাজাত রূপাকাশ্রয়ী কবিতা। 
“ প্যারাসিটামল খেতে খেতে এই দেহে আর কোনও অ্যাকশন কিংবা রিঅ্যাকশন হয় না। তাই আজকাল ফেনসিডিল প্যান্টের পকেটে ঢেলে শিশিগুলোই চিবিয়ে চিবিয়ে খাই। ভোরে ঝাপসা চোখে দেখি ফ্লোর জুড়ে কালচেরং রক্ত।-----------------------------------------------।“

গ্রাম শহরের বিভাজন, আগ্রাসী বিস্তারমানতায় গ্রামীন শুদ্ধ চরিত্রের স্খলন এবং অনিবার্যতায় কলুষাচ্ছন্নতার ব্যাপক বিস্তৃতির প্রেক্ষিতে সুমিত উপস্থাপন “আমাদের দুঃখ ওড়ে শহরে শহরে”
“আমাদের দুঃখ, মুখে মুখে ওড়ে। শহরে শহরে ঘুরে। বিকাশ হয় গ্রাম থেকে গ্রামে। আমাদের মা ছেঁড়া আঁচলে মুখ গুঁজে প্রার্থনা করেন, আমাদের দুঃখ লাঘবের। দিনদুপুরে সে প্রার্থনা হাইজ্যাক হয়ে যায়।----------------------------------------------------------------------------------
------আমাদের মায়ের ভেতর থেকে নেমে আসে আদম হাওয়ার কঙ্কাল। আর আমরা সবকিছু ভুলে টুলে ফের ঢুকে পড়ি সেই কঙ্কালের ভেতর।---এখন আমার আর কঙ্কালের মধ্যে কোন ডিফারেন্স নেই।“

“কালের জলে ভাসমান চোখ” ধ্রুপদী বিন্যাসের হিরন্ময় বোধের অমিত উচ্চারণ। 
“পিতামহের খুলে দেয়া চোখ দুটো বাবার পকেট থেকে পড়ে গেলে, আমি বাবার খুলে দেয়া একটি চোখ বুকপকেটে রেখে সাগরপাড়ে এসে দাঁড়াই। সাগরের উত্তালনাভি ভেঙে পালিত হাঙর কেড়ে নিয়ে যায় সেই চোখ।----------------------------------------------।“

“জীবনছায়ায়, জন্মফলকের আত্মসমর্পণ” আর একটি মানবানুভব ঋদ্ধ অন্তর গভীর সংবেদনার উপস্থাপন। 
“যখন জীবনের সঠিক স্পেলিং আমাদের বেলায় শর্টকাট হয়ে যায়, আমাদের বুকের ভেতর স্পষ্ট হতে থাকে খুরের আওয়াজ। চোখ দিয়ে বের হয়ে যায় সবগুলো ঘোড়া। শহরের দিকে। আমরা ডিকশনারাতি হাতে নিয়ে দৌড়াতে থাকি ইউনিভার্সিটির দিকে---------------------------------।“

স্খলন প্রপীড়িত অনন্দ্য সমাজের পঁচন ক্লিষ্টতার চিত্রায়ন “দিনমণির আঁধারতলে ভাঙে নাবালক জীবন” কবিতাটি। 
“আমাদের দেহ হাত-পা মাথা; পড়ে থাকে রেললাইনে। আমাদের দেহ, মুন্ডু বিচ্ছিন্ন করে দেয় ধারালো কিরিচ। আমাদের ঘরে ঘরে মাতম হয়। আর আমরা সেমাই’র খুশবুতে খুঁজি ঈদের আনন্দ---------------------------------------------------------।“

“পিডিএফ ফাইলে, জীবনের জলছাপ” প্রযুক্তি উৎকর্ষতায় বন্দী মানবানুভবের নাভিশ্বাসের গীতল চিত্রায়ন। 
“একদিন অকস্মাৎ বৃষ্টির সাথে আমাদের ঘরে নেমে এলো আলুরঙ আলো। আর মা সেই আলো দু’হাতে ধরে ঢেলে দিয়ে জলাক্ত উনুনে পুড়তে লাগলেন নিজস্ব পাঁজরের আগুনে। যে আগুনে মা প্রতিদিন একবার সেদ্ধ করেন সংসারের হাড্ডি-----------------------------------।

বিশ্লেষিত আত্ম অনুভবের জারিত বোধের সংশ্লেষিত প্রকাশ “টু বি কনটিনিউড” কবিতায়। 
“আমাদের জন্মগুলো আগুনের ফাতরামিডানা ভেঙে, পুড়ে পুড়ে কাবাব হয়। আমরা সেই কাবাব সিঁড়িতে বসে চুপচাপ খাই। আমাদের চোখ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে নামে জল। আমাদের তেষ্টা লাগে না। আমাদের চোখের ভেতর নদী বহে---------------------------------------------।“

ভিন্ন আঙ্গিকের কয়েকটি কবিতা আলোচনা করা যেতে পারে। ছোট পরিসরে বৃহত্তর জীবনবোধ ও জীবনচেতনার জলছবি আঁকা হয়েছে নিম্নোক্ত কয়েকটি কবিতায়। সিঁড়ি; কাগজের ফুল; লোডশেডিং; মাইলফলক জীবন; বিগত জন্মস্টাটাস –এমনই কয়েকটি কবিতা। কবিতাসমূহের নির্বাচিত কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত করা হলো। 
১/“সিঁড়ি”
ওয়েস্টিন কিংবা রেডিসন ব্লু’র
দরজা খুলে নেমে আসে 
শত শত শ্যাডো
বুকের ছাদে আমার ডিজে পার্টি।
ফরাসি শ্বাসে গন্ধ্যে 
মাতাল আমি
জোছনার গ্রিল ভেঙে
শ্যাডোর নাভিতে
ঠোঁটের বেলিড্যান্স-------------------------------------।“

২/ “কাগজের ফুল”
“চোখের টবে
স্বপ্নগুলো কাঁচ
ডাবল ডেকার ঢেউ
ভেতরে
সমুদ্র
ডাইনিং টেবিল
শূন্য গ্লাস
কাঁচ ভাঙে
আমি ভাঙি
আসলে দোলনা হচ্ছে
দাবা অথবা মৃত্যু প্রতিযোগিতার 
বেস্ট প্লেইস।“

৩/ “লোডশেডিং”
“পকেটের ভেতর থেকে 
উঠে এলে দীর্ঘশ্বাস
তিন টুকরো ইটের চুলোয়
খড়ের আগুনে পুড়ে দৃষ্টিগুলো।
আর চামড়ার ভেতর শুরু হয়
শুকনো হাড্ডির ঝটিকা মিছিল।---------------------------।“

৪/ “মাইলফলক জীবন”
“গ্রামগুলো ঢুকে যাচ্ছে শহরের পকেটে।
আর আমি গ্রামের অন্ধকার মেখে
দাঁড়িয়ে থাকি মাইলফলকের মতো।----------------------------------।“

৫/“বিগত জন্মস্ট্যাটাস”
“রাত গভীর হলে
বুকের প্যাকেট খুলে বেরিয়ে আসে
নিষিদ্ধ ফল
ফলগুলো মাইক্রোওয়েভে সেদ্ধ হচ্ছে।----------------
--এখন নিষিদ্ধ গাছের-
চামড়ায় মোড়া আমার আঙ্গুল
কী-বোর্ড মাথাকুটে; আর
আকাশ নেমে এলে
টেবিলের ওপর; তারা ভেঙে
ফ্লাশ করে, বিগত জন্মের স্ট্যাটাস।“

গ্রন্থভূক্ত অনালোচিত কয়েকটি কবিতার নাম উল্লেখ করা হলো। ধ্রুপদি চারিত্র্যের এইসব কবিতার কোনটি গীতল, কোনটি নৈব্যর্ক্তিক, কোনটি রূপকাশ্রয়ী, কোনটি প্রতীকি ব্যাঞ্জণায় উজ্জ্বল। সুপাঠ্য বিবেচিত হওয়ায় কবিতাগুলির শিরোনাম উল্লেখ করা হলো। 

অন্যান্য অত্যাধুনিক ফর্মের কবিতা- 
একটি আনকাট নিজস্ব কম্বিনেশন;কালোফিতার আড়ালে, আজকাল;ট্যাম্বারিন ঝংকারে জ্বলে যে জীবন;বৃত্ত পেরিয়ে যখন ছায়ারা হাঁটে;ডালির চোখে আকাশ দ্যাখা;রংধনু কিংবা সাদাকালো ওয়াল;রাতের পরাগায়ন;লালরং রাত;মানুষ;দিগন্তরেখা থেকে বিচ্যুত লন্ঠন;একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া;আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা;বিগত মেমোরি;নগ্ন দেওয়ালের গভীরে;জনম;জলের নখ কিংবা আয়না বিভ্রাট;ফকই ও অন্যান্য;দহনের পরকীয়া;ববিন আর জীবন;জলমুখী পদচিহ্ন;সভাকক্ষটিতে আমাদের ভাগ ছিল; একটি নিজস্ব গল্প ও অন্যান্য;সংকেত ও অরণ্য;সুইসাইড নোট;বুকের পংক্তি থেকে খসে পড়ে বর্ণ;কবিতার ফুটস্টেপ;হোয়াইটক্রাইম ও আশ্চর্যবোধক চিহ্ন;দৃষ্টি ও অন্যান্য;ব্যারিকেড ভেঙে নামে যে বীজ;আমি ও প্রতি-জন্ম;জোছনা পালানো সময়ের গল্প; ক্রম; পৃথিবী ও ট্রেনের আত্মহত্মা;সাফরন ওয়ালডেনের ভূত ও বন্ধুদের গল্প;খুশবায়িত হাসের ভেতর, অন্ধকারপর্ব;

কবি এ এক এম আব্দুল্লাহ’র কবিতায় উত্তর আধুনিক কবিতা নির্মাণ প্রয়াস লক্ষণীয়। আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ এবং যাপিত জীবনে এর অপরিহার্য প্রবেশ-অনুপ্রবেশ তার যাবতীয় অনুষঙ্গ, ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে আমাদের নিত্য প্রাত্যহিকে অস্তিত্বমান। এই বাস্তবতা সর্বব্যাপী। উন্নত বিশ্বের পরিধি ছাড়িয়ে আমাদের মত প্রযুক্তিতে দ্রুত উন্নয়নগামী দেশেও এর প্রভাব এবং প্রবেশ-অনুপ্রবেশের বাস্তবতা আদৌ উপেক্ষণীয় নয়। কবিতা ক্ষেত্রেও এর ছাপ পড়বেই। প্রত্যক্ষে কখনো, কখনো অদৃশ্য জলছাপে। কবি আব্দুল্লাহ’র কবিতায় কোনরকম আড়াল বা ধ্রুপদী প্রয়াস ছাড়াই সরাসরি প্রযুক্তি ও জীবনাচারের মিথস্ক্রিয়া উপস্থাপন করা হয়েছে। কবি নিজে প্রযুক্তিতে অগ্রসর দেশ যুক্তরাজ্যে দীর্ঘ প্রবাসে। সচেতনে এবং অবচেতনে এই প্রভাব বিমুক্তি সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। অথবা হতে পারে সচেতনাতেই তিনি প্রযুক্তি বিধৌত নব আঙ্গিকের কবিতাধারা নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন।

এই প্রয়াসে শতভাগ সফল তিনি কিনা, অথবা বোদ্ধা পাঠকের কাছে এর আবেদন সাগ্রহে আদরনীয় হবে কিনা, অথবা কবিতার মৌল আকর্ষণের সাথে এই প্রয়াসের সাংঘর্ষিকতা বিষয়ক দ্বন্দ্বমানতা দেখা দেবে কিনা, অথবা রূঢ় প্রত্যাখ্যানে এবম্বিধ উদ্যোগকে প্রত্যাখ্যানে কেউ কেউ ব্রতী হবেন কিনা এখনই সে বিষয়ে মন্তব্য করা যাচ্ছেনা। করা সমীচিনও হবেনা।

সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পের সকল শাখা-প্রশাখার মত কবিতাও চলিষ্ণু, গতিময়। তাই আবেষ্টনিক প্রয়াস বা রীতিবদ্ধতার রায় চূড়ান্তভাবে দেওয়ার ধিকার কারো একক বা গোষ্ঠিগত হতে পারে না। দেশজ ভৌগলিক পরিসীমা বা নির্দিষ্ট ভাষিক গন্ডীতে আবদ্ধকরণ প্রয়াসও যৌক্তিক না হওয়ারই কথা। সেই হিসেবে নিরীক্ষাধর্মী এই নির্মাণ প্রয়াসকে প্রত্যাখ্যান করার বাস্তবতা নেই।

পাশাপাশি এটাও স্মর্তব্য, সর্বপাঠকের গ্রহণীয় ও বোধগম্যতার বিষয়টিও উপেক্ষণীয় নয়। কেবলমাত্র স্বীকৃত বোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী বা কবি-পাঠকদের কাছে পাঠ-সীমিতকরণ যৌক্তিক কিনা এটাও বিচার্য। জনমানুষের কাছে বোদ্ধ, গ্রহন্য না হতে পারলেও অন্তত কবিতা প্রেমীদের বোধের দরোজা অর্গলাবদ্ধ না করাই বাঞ্ছনীয়। কাব্যগ্রন্থটির ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ট কবিতায় আধুনিক প্রযুক্তি, বিশেষত যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রাদির উপকরণ, যন্ত্রাংশ এবং সংলগ্ন-সংশ্লিষ্ট শব্দ ইত্যাকার বিষয় ব্যাপক ব্যবহৃত। এতে সাধারণ কবিতা পাঠক এবং ইলেকট্রনিক যন্ত্র-জ্ঞান স্বল্প পাঠকের কাছে এসবের আবেদন ও বোধগম্যতা এবং অপরিহার্যভাবেই আদরণীয়তা হ্রাসের আশঙ্কা থেকেই যায়। কবি এ বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। আঙ্গিক পরিবর্তন না করেও বোধগম্যতার বিষয়টি বিবেচনার্হ মনে করি।

কাব্যগ্রন্থটিতে কবি নির্মলেন্দু গুণের শুভেচ্ছাবাণী গ্রন্থের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। কবি এ কে  আব্দুল্লাহ’র “ ই মেইল বডিতে সময়ের অনুবাদ” সুনির্মিত কাব্যগ্রন্থ। কাব্যগ্রন্থটির প্রচ্ছদ আরও একটু আকর্ষণীয় হতে পারতো। এমন একটি সমৃদ্ধ কাব্যগ্রন্থের মুদ্রণ ও প্রকাশনায় অধিকতর যত্নবান হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিলো। প্রচুর সংখ্যক মুদ্রণ প্রমাদ পাঠককে পীড়িত করবে। কাগজের মান ও বাঁধাই সন্তোষজনক। আমি কাব্যগ্রন্থটির বহুল পঠন ও পাঠকপ্রিয়তা কামনা করি। কবি এ কে এম আব্দুল্লাহ’ ক্রমোৎকর্ষে অধিকতর মানোন্নত কবিতা নির্মিতিতে নিবেদিত থাকবেন, এই প্রত্যাশা রইলো আমাদের।
--------------------------------------

লালমাটিয়া, ঢাকাঃ মে ১২, ২০২২ 

শেয়ার করুন