السبت، 3 أبريل 2021

বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ কিঞ্চিত আলোচনা



মোঃ আব্দুল মালিক

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা, বিশে^র নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর, বাঙালি জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু, হালের বিশ^বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম-শতবার্ষিকী-‘মুজিববর্ষ’ বাংলাদেশ সহ বিশে^র বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থায় অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে, গুরুত্ব সহকারে পালিত হচ্ছে। এমনটি অন্য কোন বিশ^ নেতার বেলায় হয় নি। কিন্তু কেন ? কী ছিল তাঁর জীবনাদর্শ ? বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ বিশাল ও বহুমাত্রিক। তাঁর উচ্চমার্গের জীবনাদর্শ নিয়ে আলোচনার যোগ্যতা আমি রাখি না। তবে এখানে বঙ্গবন্ধুর জীবনের একেবারে প্রাথমিক ও সাধারণ কিছু জীবনাদর্শ নিয়ে কিঞ্চিত আলোচনা করছি।

সাধারণভাবে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ ছিল-

১) অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হওয়া।

২) অন্যায়ের কাছে মাথানত না করা।

৩) ভয়ে পালিয়ে না যাওয়া।

৪) অকপটে সত্য স্বীকার করা।

৫) আত্মসম্মান বজায় রাখা।

৬) লোভ না করা।

৭) জাতিকে ভালোবাসা।

৮) মানুষের উপর আস্থা ও বিশ^াস।

৯) আত্মচিন্তা না করা।

১০। মহান স্রষ্টার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ^াস।


১) অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হওয়াঃ বঙ্গবন্ধু ছিলেন খুবই অধিকার সচেতন। তিনি যখন মাত্র সপ্তম শ্রেণির ছাত্র তখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও বাণিজ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ আসেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মিশন হাইস্কুল পরিদর্শনে এলে তরুণ শেখ মুজিব তাঁর পথ আগলে ধরে স্কুলের হোস্টেলের ছাদের সমস্যার বিষয়টি উত্থাপন করেন। তারপর ভারতবাসীর অধিকার আদায়ের জন্য তিনি স্বদেশী আন্দোলনে যোগদেন। স্বাদেশী আন্দোলন যখন হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রূপ নিল, যখন মুসলমানদের অধিকারের প্রশ্নটি সামনে চলে আসলো তখন তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে যোগদেন। পাকিস্তান আন্দোলনের সফল সমাপ্তির পর তিনি যখন দেখলেন বাঙালিদের বঞ্চিত করা হচ্ছে তখন তিনি বাঙালির অধিকার আদায়ে আজীবন সংগ্রাম করে বাঙালি জাতির পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দিয়ে গেছেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কর্মচারীদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে তিনি বিশ^বিদ্যালয় থেকে বহিস্কার হয়েছিলেন। অধিকারের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু কখনো আপোষ করেন নি।


২) অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করাঃ অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার আদর্শ তিনি সেই ছোটবেলা থেকেই লালন করে আসছেন। তাঁর বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি অনিয়ম করলে তিনি এর প্রতিবাদ করেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে তাঁকে যখন মুচলেকা ও জরিমানা দিতে বলা হয়, তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে স্বেচ্ছায় বহিস্কারাদেশ মেনে নেন। তবুও অন্যায়ের কাছে মাথানত করেন নি। তিনি এমন সময় ফিলিস্তিনি মুসলমানদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, যখন প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানরা চুপ করে বসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,‘ আমার অবস্থা যদি চিলির আলেন্দের মতো হয় তবুও আমি সাম্রাজ্যবাদীর কাছে মাথা নত করব না।’ আমৃত্যু তিনি কারো কাছে মাথা নত করেন নি।


৩) ভয়ে পালিয়ে না যাওয়াঃ ভয়ে পালিয়ে না যাওয়ার আদর্শ বঙ্গবন্ধু সেই ছোট বেলায়ই অর্জন করেন। তাঁর বাল্য বন্ধু আব্দুল মালেক কে হিন্দু মহাসভার নেতা তাঁর বাড়িতে বেঁধে রাখেন, তখন তাকে ছাড়িয়ে আনতে গিয়ে হিন্দুদের সাথে মারামারি করার জন্য প্রভাবশালী হিন্দু নেতারা তাঁর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। পুলিশ তাঁকে ধরে নিতে এসে, পালিয়ে যাবার সুযোগ দিয়েছিল কিন্তু তিনি পালিয়ে যান নি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইচ্ছা করলে তিনি আত্মগোপনে যেতে পারতেন কিন্তু তিনি প্রাণের ভয়ে আত্মোগোপনে বা পালিয়ে যান নি। অথচ সৈনিক মেজর জিয়া ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে শত্রুর কোন হুমকি ছাড়াই চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে তার বাহিনী নিয়ে পটিয়ার দিকে পালিয়ে যান। বিপ্লবী উসামা-বিন-লাদেন প্রাণভয়ে আফগানিস্তানের তোরা বোরা পাহাড়ে লুকিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কখনো এ কাজটি করেন নি।


৪) অকপটে সত্য স্বীকার করাঃ বঙ্গবন্ধু যা সত্য বলে জানতেন তা অকপটে স্বীকার করতেন, কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিতেন না। সেই বাল্যকালে হিন্দুদের সাথে মারামারির বিষয়টি বাবা শেখ লুৎফর রহমান যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন তখন তিনি চুপ থেকে বাবাকে বুঝাতে চাইলেন হ্যাঁ মারামারি করেছি। এভাবে তিনি যখন স্বাধীন বাংলাদেশের কর্ণধার তখন বললেন, ‘মানুষ পায় স্বর্ণের খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি। আমার সামনে চোর, ডানে চোর, বামে চোর, পিছনে চোর’। জাতিসংঘে গিয়ে তিনি বললেন, ‘বিশ^ আজ দুই শিবিরে বিভক্ত শোষক আর শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে।’ এভাবে তিনি সারাজীবন অকপটে সত্য স্বীকার করে গেছেন।


৫) আত্মসম্মান বজায় রাখাঃ বঙ্গবন্ধু সারাজীবন আত্মসম্মান বজায় রেখে চলেছেন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দী যখন তাঁকে ঘড় নড়ফু বলেন, তখন তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছিলেন আমি প্রমাণ করব ‘আমি ঝড়সব নড়ফু.’ পরে সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁকে স্বসম্মানে ফিরিয়ে নেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার জবানবন্দী প্রদানের সময়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকে যখন গ্রেফতার করে বিমান বন্দরে নিয়ে রাখে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট যখন ঘাতকরা তাঁর বাড়ি আক্রমণ করে তাঁকে হত্যা করে তখনো তিনি তাঁর আত্মসম্মান বজায় রেখে কথা বলেছেন। দেশ স্বাধীনের পর স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জেরাল্ড ফোর্ড ও সউদি আরবের বাদশা ফয়সলসহ অন্যান্যদের সাথে কথা বলার সময় নিজের ও দেশের আত্মসম্মান বজায় রেখে কথা বলেছেন। তিনি সবসময় নিজের, দেশের ও জাতির আত্মসম্মান বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিলেন।


৬) লোভ না করাঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একমাত্র ভারত উপমহাদেশীয় রাজনীতিবিদ যিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করে পার্টির সেক্রেটারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ’৭০ সালের নির্বাচনের পর বাঙালির অধিকারের প্রশ্নে আপোষ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রস্তাব তিনি সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আর্ন্তজাতিক খ্যাতি সম্পন্ন রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকাবস্থায় তিনি তাঁর দুই ছেলেকে সাধারণ ঘরের মেয়েদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি হয়েও নিজের বাড়িতেই সাধারণভাবে থাকতেন। এভাবে তিনি সকল জাগতিক লোভ লালসার উর্ধে ছিলেন।


৭) জাতিকে ভালোবাসাঃ তিনি সব সময় তাঁর জাতিকে ভালোবাসতেন। তাইতো ভারতবাসীর স্বাধীনতার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনে, তারপর মুসলমান জাতির পক্ষে পাকিস্তান আন্দোলনে, পরে বাঙালি জাতির স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। তিনি কখনো স্বজাতি-স্বভূমির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন নি। উল্লেখ্য ১৯০৬ সালে যখন মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন পাকিস্তানের জনক খ্যাত তরুণ ব্যারিস্টার মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেসে যোগদান করেছিলেন। এদিক থেকে বঙ্গবন্ধু সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। পাকিস্তানি কারাগারে যখন তাঁর জন্য কবর খোঁড়া হয় তখন তিনি তাদেরকে বলেছিলেন আমাকে ফাঁসি দেও, আপত্তি নেই, তবে আমার লাশ আমার বাঙালির কাছে পাঠিয়ে দিও, এই আমার অনুরোধ। স্বাধীনতার পর এক বিদেশী সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা আমি আমার মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসি।”


৮) মানুষের উপর আস্থা ও বিশ^াসঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মানুষকে ভালবাসতেন, মানুষকে বিশ^াস করতেন। এই বিশ^াষে তিনি কখনো জিতেছেন আবার কখনো হেরেছেনও। ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দিবে।’ হ্যাঁ বাঙালিরা ঠিকই বন্ধ করে দিয়েছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। আবার তিনি যাদেরকে বিশ^াস করেছিলেন তাদের হাতেই শহীদ হয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে সতর্ক করেছিলেন কিন্তু তিনি বিশ^াস করেন নি। আর বিশ^াস না করেই স্ব-পরিবারে তাঁকে শাহাদৎ বরণ করতে হয়েছে। তবে তাঁর এই বিশ^াস ও আত্মত্যাগ বৃথা যায় নি। তিনি বীরের মতো বাঙালি জাতির হৃদয়ে, বিশ^বাসীর হৃদয়ে অবস্থান করছেন। আর ঘাতক ও তাদের সহযোগিরা মীরজাফর উপাধি পেয়ে ইতিহাসের আস্থাকূড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।


৯) আত্মচিন্তা না করাঃ বঙ্গবন্ধু সারাজীবন কখনো আত্মচিন্তা করেন নি। তিনি সব সময় মানুষের, জাতির ও বিশ^বাসীর চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি যদি আত্মচিন্তা করতেন তাহলে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হওয়ার পরও ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। তারপর গৃহ নির্মাণ ঋণ নিয়ে ধানমন্ডির বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি হয়েও সেই বাড়ির ঋণ শোধ করতে পারেন নি। মৃত্যুর পর তাঁর বাড়ি ঋণের দায়ে নিলাম হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।


১০) মহান স্রষ্টার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ^াসঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন একজন খাঁটি বাঙালি ছিলেন তেমনি একজন খাঁটি মুসলমানও। ছয় দফা আন্দোলন থেকে তাঁকে বিরত রাখতে শাসক গোষ্টী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে ফাঁসি কাষ্টে ঝুলাতে চাইলেও তিনি ছয় দফা থেকে সরে আসেন নি। ২৫ মার্চ ’৭১ প্রাণের ভয়ে তিনি পালিয়ে যান নি। এমনকি পাকিস্তানী কারাগারে তাঁর জন্য যখন কবর খোঁড়া হয় তখনও তিনি ভয়ে ভীত হন নি বা যখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সতর্ক করেন তখনও তিনি নিজের বাসা ছেড়ে সরকারী সুরক্ষিত বাসায় উঠেন নি। এর থেকে প্রমাণ হয় তিনি শুধু মুখে ইসলাম লালন করতেন না, তিনি অন্তর দিয়ে ঈমান ও ইসলাম লালন করতেন। তিনি তাওয়াক্কালতু আলাললায় পূর্ণ আস্থা ও বিশ্ববাসী ছিলেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই জীবনাদর্শ বাঙালি জাতি ও বিশ^বাসীর জন্য এক অমূল্য সম্পদ। স্বাধীন বাংলাদেশ বার বার পথ হারিয়েছে আবার বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথেই দিশা পেয়েছে। যতদিন বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর এই আদর্শ লালন করবে ততদিন বাংলাদেশ বিশে^র বুকে গৌরবের সাথে, সম্মানের সাথে টিকে থাকবে। তাই মুখে নয় কাজে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করতে হবে।


লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট।


শেয়ার করুন